১৯৭১ সালের জুলাই মাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারন করেছে। স্থলের পাশাপাশি জলপথেও পাকবাহিনীর উপর হামলা শুরু করেছে বাংলাদেশ।
দেশী ডিঙ্গি নৌকার উপর হেভী মেশিনগান বসিয়ে নদীপথে হালকা আক্রমন চালানো যাচ্ছে। কিন্ত সাগরে যুদ্ধের জন্য চাই পেশাদার নৌবাহিনী। এই প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা ৪৫ জন নৌসেনা ও ২ টি ক্ষুদ্র যুদ্ধজাহাজ নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
যুদ্ধ চলাকালে ৯ নভেম্বরে ভারত বাংলাদেশকে ৫ টি ছোট আকারের স্পিডবোট উপহার দেয়। কিন্ত পরেরদিনই ভারতীয় বিমানবাহিনী ভূল করে হামলা চালিয়ে সেই স্পিডবোটগুলো ধ্বংস করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশী নৌবাহিনী ১০ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনা করে কোন প্রকার যুদ্ধজাহাজ ও মিসাইল ছাড়াই অর্ধশতাধিক জাহাজ ধ্বংস করেছিল।
এছাড়া ৩৩৪ জন নৌ-সেনা মংলা বন্দরে সফল অপারেশন চালিয়েছিল। গঠনের মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ নৌবাহিনী পাকসেনাদের মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সমূদ্র রক্ষায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভূমিকা রেখে আসছে। জিয়াউর রহমানের আমলে বাংলাদেশ নৌবাহিনী দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের দখল নিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিল।
এছাড়া, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়া মায়ানমার নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের বহরকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশ নৌবাহিনী দ্রুত উন্নত হতে থাকে। ১৯৭৮ সালের মাঝেই ইউরোপ থেকে ২ টি স্যালিসবারি ক্লাস ফ্রিগেট যুক্ত হয়। ১৯৮২ সালে ইউরোপ থেকে ১ টি লিওপার্ড ক্লাস ফ্রিগেট কিনে নিয়ে আসা হয়।
এছাড়া, চীন থেকে প্রচুর মিসাইল বোট, গানবোট ও টর্পেডো বোট যুক্ত করা হয়। ফলে এই অঞ্চলে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী নৌবাহিনীর অধিকারী হয়ে ওঠে। বর্তমানে ১১০+ জাহাজ ও ২০,০০০+ জনবল নিয়ে এই বাহিনী তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
বাহিনীর মূলমন্ত্র হচ্ছে – শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয় (In War and Peace Invincible at Sea)।
নৌবাহিনীর এভিয়েশন উইং এ আছে ২ টি AW109 হেলিকপ্টার এবং ২ টি ডরনিয়ার-২২৮ মেরিটাইম পেট্রল এয়ারক্রাফট।

এডব্লিউ১০৯ হেলিকপ্টার

ডরনিয়ার-২২৮ মেরিটাইম পেট্রল এয়ারক্রাফট
এছাড়া নৌবাহিনীর একটি দক্ষ স্পেশাল ফোর্স আছে যার নাম SWADS
আসুন দেখে নিই বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কিছু যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধাস্ত্রের নামঃ
ফ্রিগেটঃ আমাদের নৌবাহিনীর মোট ৬ টি ফ্রিগেট সার্ভিসে আছে।
১. উলসান ক্লাস ফ্রিগেট(দক্ষিন কোরিয়া) = ১ টি

বিএনএস বঙ্গবন্ধু বা উলসান ক্লাস ফ্রিগেট
২. হ্যামিল্টন ক্লাস ফ্রিগেট(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) = ২ টি

বিএনএস সমুদ্র অভিযান বা হ্যামিল্টন ক্লাস ফ্রিগেট
৩. টাইপ-৫৩এইচ১ ফ্রিগেট(চীন) = ১ টি

বিএনএস ওসমান বা টাইপ-৫৩এইচ১ ফ্রিগেট
৪. টাইপ-৫৩এইচ২ ফ্রিগেট(চীন) = ২ টি

বিএনএস আবু বকর বা টাইপ-৫৩এইচ২ ফ্রিগেট
বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে এবছরই আরো ২ টি টাইপ-৫৩এইচ৩ ফ্রিগেট যুক্ত হবে।
করভেটঃ ৪ টি
১. স্বাধীনতা ক্লাস করভেট(চীন/বাংলাদেশ) = ২ টি

স্বাধীনতা ক্লাস বা টাইপ-৫৬ করভেট
২. ক্যাসেল ক্লাস করভেট(ব্রিটেন) = ২ টি
আরো ২ টি স্বাধীনতা ক্লাস করভেট এবছরই যুক্ত হবে এবং দেশে এটির উপর ভিত্তি করে আরো উন্নত ও শক্তিশালী ৪ টি করভেট বানানো হবে।

বিএনএস ধলেশ্বরী বা ক্যাসেল ক্লাস করভেট
লার্জ পেট্রল ভেসেলঃ ৬ টি
১. মেঘনা ক্লাস(সিঙ্গাপুর) = ২ টি
২. দুর্জয় ক্লাস(বাংলাদেশ) = ৪ টি। আরো ২ টি দুর্জয় ক্লাস দেশে বানানো হচ্ছে।

বিএনএস নির্মুল বা দুর্জয় ক্লাস
অফশোর পেট্রল ভেসেলঃ ১১ টি
১. আইল্যান্ড ক্লাস(ব্রিটেন) = ৫ টি

বিএনএস সাঙ্গু বা আইল্যান্ড ক্লাস
২. সী ড্রাগন ক্লাস(দক্ষিন কোরিয়া) = ১ টি
৩. পদ্মা ক্লাস(বাংলাদেশ) = ৫ টি

পদ্মা ক্লাস অফশোর পেট্রল ভেসেল
ফার্স্ট এটাক ক্রাফটঃ ১৪ টি
১. টাইপ ২১ ক্লাস মিসাইল বোট(চীন) = ৪ টি
২. টর্পেডো বোট = ৫ টি

টর্পেডো বোট
৩. চামসুরি ক্লাস গানবোট(দক্ষিন কোরিয়া) = ৪ টি
৪. টাইপ২১ গানবোট(চীন/বাংলাদেশ) = ১ টি
সার্ভে শিপঃ ২ টি। আরো ২ টি দেশেই বানানো হচ্ছে।

বিএনএস অনুসন্ধান বা রোয়েবাক ক্লাস সার্ভে শিপ
- মাইন পরিষ্কারক জাহাজ = ৫ টি
- প্রশিক্ষন জাহাজ = ১টি
- ল্যান্ডিং ক্রাফট = ১৫ টি
- রিপেয়ার শিপ = ১ টি
- অয়েল ট্যাংকার = ২ টি
- সাহায্যকারী জাহাজ = ১১ টি

ল্যান্ডিং ক্রাফট ইউটিলিটি
সাবমেরিনঃ
১. মিং ক্লাস সাবমেরিন(চীন) = ২ টি

বিএনএস নবযাত্রা ও জয়যাত্রা বা মিং ক্লাস সাবমেরিন
র্যাপিড রেসপন্স বোটঃ ৩২ টি
১.ডিফেন্ডার ক্লাস বোট(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) = ১৬ টি

ডিফেন্ডার ক্লাস রেসপন্স বোট
২. এক্স১২ হাইস্পিড পেট্রল বোট(বাংলাদেশ) = ১৬ টি।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ব্যবহৃত মিসাইলঃ
- অটোম্যাট মার্ক-২ এন্টিশিপ মিসাইল, ইতালী। রেঞ্জ- ২০০-২২০ কি.মি.
- সি-৮০২ আলফা এন্টিশিপ মিসাইল, চীন। রেঞ্জ- ১৮০ কি.মি.
- সি-৭০৪ এন্টিশিপ মিসাইল, চীন। রেঞ্জ- ৩৫ কি.মি.(বাংলাদেশে এই মিসাইল বানানোর ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে)।
- FM-90N সার্ফেস টু এয়ার মিসাইল, চীন। রেঞ্জ- ১৫ কি.মি.
- FL3000N সার্ফেস টু এয়ার মিসাইল, চীন। রেঞ্জ- ১০+ কি.মি. (উল্লেখ্য বাংলাদেশে এই মিসাইল তৈরি করা হবে)।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ ক্রমাগত আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ইউরোপ থেকে আরো ২ টি ডরনিয়ার ২২৮ মেরিটাইম পেট্রল এয়ারক্রাফট অর্ডার করেছে। এছাড়া ইতালীর AW159 wildcat হেলিকপ্টার কেনা হয়েছে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের জন্য কেনা হয়েছে AW101 হেলিকপ্টার। চীন থেকে আরো ২ টি স্বাধীনতা ক্লাস করভেট এবং ২ টি মডিফায়েড টাইপ-৫৩ এইচ৩ ফ্রিগেট এবছর ডেলিভারি দিবে। এছাড়া, দেশেই ২ টি দুর্জয় ক্লাস এলপিসি, ২ টি সার্ভে শিপ, ১৬ টি হাইস্পিড পেট্রল বোট ও কিছু অফশোর পেট্রল ভেসেল বানানো হচ্ছে।

দুটি হ্যামিল্টন ক্লাস ফ্রিগেটের সাথে দুর্জয় ক্লাস এলপিসি
চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেডে এবছর থেকেই স্বাধীনতা ক্লাস করভেটের উপর ভিত্তি করে নতুন প্রজন্মের করভেট বানানো শুরু হবে এবং দেশে বানানো ৪-৬ টি করভেট নৌবাহিনীতে যুক্ত হবে।
এছাড়া, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য নতুন ৮ টি ফ্রিগেট প্রযুক্তিসহ কেনা হবে। এর মাঝে ২ টি ফ্রিগেট বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে এবং বাকি ৬ টি ফ্রিগেট দেশেই বানানো হবে। এক্ষেত্রে টাইপ ৫৪এ, বেলহেরা ক্লাস, দায়েগু ক্লাস, সভেরাইন ক্লাস, টাইগার ক্লাস ইত্যাদি ফ্রিগেট বিবেচনায় আছে।

টাইপ-৫৪এ ফ্রিগেট

টাইপ-৫৪এ ফ্রিগেটের হেলিকপ্টার ডেক
এছাড়া, ২০২০-২১ সালের মাঝে আরও ২-৪ টি অত্যাধুনিক এটাক সাবমেরিন কেনা হবে। এসবের জন্য আমাদের নৌ-ঘাটির উন্নয়ন ও সংখ্যাবৃদ্ধি অব্যাহত আছে।
Leave a Reply